বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরসহ বেশ কয়েকজন সিনিয়র নেতা কারাগারে। গ্রেফতার আতঙ্কে কেন্দ্রীয় নেতারা আত্মগোপনে। ঘরছাড়া তৃণমূলের বেশিরভাগ নেতাকর্মী। পরিস্থিতি যাই থাকুক একদফা দাবিতে কঠোর কর্মসূচি থেকে পিছু না হটার সিদ্ধান্ত নিয়েছে বিএনপি। গ্রেফতার-মামলার কারণে কিছুটা চাপে পড়লেও আন্দোলনের সফলতা নিয়ে আশাবাদী দলটি। দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনের তফশিল ঘোষণার আগেই দাবি আদায় করতে চায়। সেভাবে নেওয়া হচ্ছে নানা প্রস্তুতি। অতীতের আন্দোলন থেকে শিক্ষা নিয়ে এবার ভিন্ন কৌশলে এগোচ্ছে।
এক নেতা গ্রেফতার হলে বিকল্প আরেকজনকে নেতৃত্ব নিতে বলা হয়েছে। সিনিয়র নেতাদের রাখা হয়েছে মাঠ সাজানোর পরিকল্পনায়। আর কর্মসূচি বাস্তবায়নের দায়িত্বে মধ্যম সারির ও জেলা পর্যায়ের নেতারা। সব বিষয়ে কঠোর গোপনীয়তা রক্ষার জন্য হাইকমান্ড থেকে নির্দেশনা রয়েছে। এমনকি কর্মসূচির বিষয়েও ঘোষণার কয়েক ঘণ্টা আগে জানানো হচ্ছে স্থায়ী কমিটির সদস্যদের। সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে এসব তথ্য।
আরও জানা গেছে, নির্বাচনের তফশিল ঘোষণার আগপর্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ নেতাদের গ্রেফতার এড়িয়ে চলতে বলা হয়েছে দলের শীর্ষ নেতৃত্ব থেকে। এ কারণে কেন্দ্রীয় নেতারা আত্মগোপনে রয়েছেন। তবে দায়িত্বশীল কোনো নেতা গ্রেফতার হলে মাঠের আন্দোলন চালিয়ে যেতে অন্য কোনো নেতা সে দায়িত্ব পালন করবেন। এ বিষয়ে ২৮ অক্টোবরের মহাসমাবেশের আগেই এক ধরনের দিকনির্দেশনা দেওয়া হয়েছিল; যাতে কর্মসূচি ঘোষণা ও বাস্তবায়নে সমস্যা না হয়।
যুক্তরাজ্য থেকে বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান আন্দোলন-কর্মসূচি তদারকি করছেন। জানতে চাইলে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য ড. আব্দুল মঈন খান যুগান্তরকে বলেন, আর পিছু ফেরার সময় নেই। জুলুম-নির্যাতন, মিথ্যা মামলা-হামলা, গ্রেফতার করে আন্দোলন স্তব্ধ করার কোনো সুযোগ নেই। বিএনপির প্রতিটি কর্মীই নেতার ভূমিকা পালন করে এ আন্দোলনে সফলতা আনবে।
তিনি আরও বলেন, সরকার পতনের একদফা দাবিতে আমরা শান্তিপূর্ণ গণতান্ত্রিক আন্দোলনে অটল রয়েছি। যে নিয়মতান্ত্রিক আন্দোলন চলছে তা অব্যাহত থাকবে। দেশের গণতন্ত্র পুনরুদ্ধারের আন্দোলনকে নস্যাৎ করা যাবে না।
বিএনপির সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী যুগান্তরকে বলেন, বর্তমান শাসকগোষ্ঠী বিএনপির নেতৃত্বে অবরোধ কর্মসূচিতে ভীত হয়ে পড়েছে বলেই হিতাহিত জ্ঞান হারিয়ে ফেলেছে। সরকার ভাবছে, এভাবে গ্রেফতার, রিমান্ডে নিয়ে নির্যাতন এবং জুলুম চালালে আন্দোলন স্তব্ধ হয়ে যাবে। কিন্তু বিএনপি দেশের বৃহৎ ও জনপ্রিয় রাজনৈতিক দল।
এ দলটির সঙ্গে জনগণ রয়েছে। কাজেই আন্দোলন দমানোর জন্য সরকারের কোনো কৌশলই সফল হবে না। বিএনপির নেতৃত্বকেও দুর্বল করা যাবে না। কারাগারের বাইরে থাকা বিএনপির সর্বশেষ ব্যক্তিটি আন্দোলনের নেতৃত্ব দেবে। আন্দোলনের মাধ্যমেই সরকারের পদত্যাগসহ নির্বাচনকালীন নির্দলীয় নিরপেক্ষ সরকার ব্যবস্থা বাস্তবায়ন করতে জনগণ সংকল্পবদ্ধ। অচিরেই অবৈধ সরকারের পতন হবে।
২৮ অক্টোবর ঢাকার মহাসমাবেশে হামলা, হত্যার প্রতিবাদে পরদিন দেশব্যাপী হরতাল পালন করে বিএনপি। এরপর ৩১ অক্টোবর থেকে টানা ৩ দিনের অবরোধ দেয় দলটি। যা বৃহস্পতিবার শেষ হলে ওইদিন বিকালে আবারও কাল রোববার থেকে টানা ৪৮ ঘণ্টার অবরোধ কর্মসূচি ঘোষণা করা হয়। নীতিনির্ধারকরা জানান, ১৫ নভেম্বরের মধ্যে তফশিল ঘোষণা হবে বলে তাদের কাছেও তথ্য রয়েছে। এজন্য অবরোধ কর্মসূচি তফশিল পর্যন্ত চলতে পারে।
সঙ্গে ‘অসহযোগ’ নামে দেশব্যাপী অবরোধ-হরতালের মতো আরও কঠোর কর্মসূচিও দেওয়া হতে পারে। খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, কর্মসূচি সফলে একটি পরিকল্পনা নিয়ে এগোচ্ছে বিএনপি। গত হরতাল ও অবরোধের ৪ দিনের কর্মসূচি পালনে রাজধানীসহ সারা দেশের বিএনপি ও অঙ্গ-সহযোগী সংগঠনের নেতাকর্মীদের দায়িত্ব ভাগ করে দেওয়া হয়।
একদিন যারা মাঠে নেমেছেন, অন্যদিন তাদের অনেককে নামানো হয়নি। আবার রাজধানী ঢাকায় এখনই সর্বোচ্চ শক্তি নিয়ে নামতে চাইছে না। ঢাকা মহানগর উত্তর ও দক্ষিণকে ৩০টি জোনে ভাগ করে দেওয়া হয়েছে। দায়িত্বপ্রাপ্তরা সমন্বয় করে মাঠে নামছেন। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক মহানগরের একাধিক নেতা জানান, তাদের মূলত টার্গেট তফশিল ঠেকানো। তাই তফশিলের কয়েকদিন আগে রাজধানীতে সর্বোচ্চ শক্তি নিয়ে নামতে চান। ঢাকাকে পুরোপুরি বিচ্ছিন্ন করে দেওয়া হতে পারে। এজন্য সব প্রস্তুতিও নেওয়া রয়েছে।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক স্থায়ী কমিটির একজন সদস্য জানান, বিএনপির চলমান আন্দোলন পুরোপুরি পরিকল্পনা অনুযায়ীই হচ্ছে। নেতাকর্মীরা এমন পরিস্থিতির সম্মুখীন হতে পারেন-এমন ধারণা নিয়েই ২ মাস ধরে দলের ৮২টি সাংগঠনিক জেলা সফর করেন দায়িত্বপ্রাপ্ত কিছু নেতা। তারা নানা নির্দেশনা দেওয়ার পাশাপাশি বিএনপি ও অঙ্গ-সহযোগী সংগঠনের সব পর্যায়ের নেতাদের ফোন নম্বরসহ বিভিন্ন তথ্য সংগ্রহ করেন। যা ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যানের কাছে রয়েছে।
সিনিয়র নেতাদের গ্রেফতার করা হবে জেনেই সব পরিকল্পনা সাজানো হয়েছে। তাই যতই প্রতিকূল পরিবেশ থাকুক আন্দোলন চালিয়ে নিতে কোনো সমস্যা হবে না। ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান ও আরও বেশ কয়েকজন নেতা দেশের বাইরে আছেন। ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যানের বিভিন্ন নির্দেশনা ওইসব নেতারা বিভিন্ন মাধ্যমে এখন তৃণমূলসহ কেন্দ্রীয় নেতাদের কাছে পৌঁছে দিচ্ছেন। আন্দোলন সফলে ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান নিজেই ইউনিয়ন পর্যায়ে কথা বলছেন।
২৮ অক্টোবর ঢাকায় মহাসমাবেশের পর থেকে শুক্রবার পর্যন্ত বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর, স্থায়ী কমিটির সদস্য মির্জা আব্বাস, আমির খসরু মাহমুদ চৌধুরী, যুগ্ম মহাসচিব মজিবুর রহমান সরোয়ার, সৈয়দ মোয়াজ্জেম হোসেন আলাল, খায়রুল কবির খোকন, সাংগঠনিক সম্পাদক বিলকিস আক্তার জাহান শিরীন, কেন্দ্রীয় নেতা জহির উদ্দিন স্বপনসহ বেশ কয়েকজন সিনিয়র নেতাকে গ্রেফতার করা হয়। আরও বেশ কয়েকজন নেতার বাসায় অভিযান চালানো হয়েছে।
তৃণমূলেরও একই অবস্থা। ঢাকা মহানগর উত্তরের সদস্য সচিব, নরসিংদী জেলার আহ্বায়ক ও সদস্য সচিব, কুষ্টিয়া ও গাইবান্ধা জেলার সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক, রংপুর মহানগরের আহ্বায়ক ও সদস্য সচিব, নড়াইল জেলার সাধারণ সম্পাদক, খুলনা জেলার আহ্বায়ক, বরিশাল মহানগরের আহ্বায়ক, বরিশাল দক্ষিণ জেলার আহ্বায়কসহ তৃণমূলের আরও কয়েকজন শীর্ষ নেতাকে গ্রেফতার করা হয়েছে। প্রতিদিনই চলছে গ্রেফতার অভিযান। ইউনিয়ন থেকে জেলা পর্যন্ত বিএনপি ও অঙ্গ-সহযোগী সংগঠনের অধিকাংশ নেতাকর্মী এখন ঘরছাড়া।
এমন পরিস্থিতিতে গ্রেফতার এড়িয়ে সতর্ক থেকে আন্দোলন সফলে নানা ধরনের দিকনির্দেশনা দেওয়া হচ্ছে। সব পর্যায়ের নেতাকর্মীকে কর্মসূচি সফলে জোরালোভাবে মাঠে নামতে দেওয়া হয়েছে কঠোর নির্দেশনা। একজন গ্রেফতার হলে বিকল্প আরেকজনকে নেতৃত্ব দিতে হাইকমান্ড থেকে তৃণমূলে বার্তা দেওয়া হয়েছে। ‘নেতৃত্ব নিন, নেতৃত্ব দিন’-এ স্লোগান সংবলিত মেসেজ পাঠানো হচ্ছে নেতাকর্মীদের মোবাইলসহ বিভিন্ন সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে।
জেলা পর্যায়ের কেউ গ্রেফতার হলে সঙ্গে সঙ্গেই তার স্থলে আরেকজনকে দায়িত্ব দেওয়া হচ্ছে। ইতোমধ্যে ঢাকা মহানগর উত্তরের যুগ্ম আহ্বায়ক এজিএম শামসুল হককে ভারপ্রাপ্ত সদস্য সচিব, নরসিংদী জেলা বিএনপির আহ্বায়ক কমিটির সদস্য সাখাওয়াত হোসেন বকুলকে ভারপ্রাপ্ত আহ্বায়ক ও যুগ্ম আহ্বায়ক আবু সালেহ চৌধুরীকে ভারপ্রাপ্ত সদস্য সচিব, কুষ্টিয়া জেলার সহসভাপতি কুতুব উদ্দিনকে ভারপ্রাপ্ত সভাপতি ও যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক প্রকৌশলী জাকির হোসেন সরকারকে ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদক হিসাবে দায়িত্ব দিয়েছে।
দিনাজপুর জেলার সিনিয়র সহসভাপতি মোকাররম হোসেনকে ভারপ্রাপ্ত সভাপতি, গাইবান্ধা জেলা যুগ্ম সম্পাদক মো. ইলিয়াস হোসেনকে ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদক, রংপুর মহানগরের যুগ্ম আহ্বায়ক শহিদুল ইসলাম মিজুকে ভারপ্রাপ্ত আহ্বায়ক ও মো. আব্দুস সালামকে ভারপ্রাপ্ত সদস্য সচিব, নড়াইল জেলার যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক কাজী সুলতানুজ্জামান সেলিমকে ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদক হিসাবে দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে। বিএনপি ছাড়াও এর অঙ্গ-সহযোগী সংগঠনের কেউ গ্রেফতার হলে আরেকজনকে দায়িত্ব দিয়ে কর্মসূচি সফলের নির্দেশনা দিয়েছে হাইকমান্ড।